আমরা জানি যে মনের ভাব আদান-প্রদান কে ভাষা বলে। একে-অপরের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ও পরস্পরকে বুঝতে পারলেই তবেই তাকে ভাষা বলা যায়। ঠিক তেমনি ব্যবহারকারীর কি চায় তা কম্পিউটার বুঝতে পারলে বা যে উপায়ে কম্পিউটার বুঝতে পারে সেই মাধ্যমকে কম্পিউটারের ভাষা বা Machine language বলে। ব্যবহারকারীর কমান্ড বুঝতে পারে কম্পিউটার বিশেষ এক পদ্ধতির মাধ্যমে। আমরা আজকে এই বিশেষ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করব এই অ্যার্টিকেলের মাধ্যমে। আমরা ইতোমধ্যে জানি যে কম্পিউটার বর্তমান কালের সবচেয়ে ব্যবহার যোগ্য ও আধুনিক একটি প্রযুক্তি যার সাহায়্যে বর্তমানে সারা বিশ্বে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের ব্যবহার্য প্রায় সকল ক্ষেত্রেই কোন না কোন কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার অবশ্যই রয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা, চিকিৎসা, রাষ্ট্রনীতি, আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানে প্রায় সকল ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার অনস্বীকার্য।
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা কি? (What is programming language?):
কম্পিউটারের নিজস্ব ভাষা হচ্ছে নিম্ন স্তরের ভাষা। কম্পিউটার শুধু মেশিন বা যন্ত্রভাষায় ০ ও ১ এই দুই বাইনারি সংখ্যা বা হেক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে সব কিছু বুজতে পারে আবার এই পদ্ধতিই গুলো ব্যবহার করেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করা হয়।
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর ক্ষেত্রে যেকোন ভাষাকে বাইনারি বা হেক্স পদ্ধতিতে অনুবাদ করে দিতে কম্পাইলার ও ইন্টারপ্রিটার ব্যবহার করা হয়।
অর্থাৎ তাহলে আমরা বলতে পারি কম্পিউটার সিস্টেমে প্রোগ্রাম লিখার জন্য ব্যবহৃত শব্দ, বর্ণ, সংখ্যা, সংকেত এবং এগুলোর বিন্যাসের নিয়ম মেনে তৈরি করা হয় Machine language বা কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ভাষা, যা পরবর্তীতে কম্পাইলার ও ইন্টারপ্রিটার মাধ্যমে বাইনারি বা হেক্স পদ্ধতিতে অনুবাদ করা হয়।
প্রোগ্রামিং ভাষার ইতিহাস (History of programming or Machine languages):
কম্পিউটার ও বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষার উদ্ভব এক দিনে বা রাতা-রাতি ঘটেনি। এর জন্য মানুষ যুগের পর যুগ অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও গবেষণা করে গেছে, যার ফলে আমরা পেয়েছে আধুনিক সব প্রযুক্তি।
আনুমানি খৃষ্টপূর্ব ৫০০০ বছর আগে চীন দেশের মানুষ রাজকীয় ও রাজস্বের হিসাব করার জন্য এ্যাবাকাস নামক যন্ত্র ব্যবহার করতো। পরর্বতীতে সারা বিশ্বব্যাপি এই ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এর ফলে প্রয়োজন পরে আরও উন্নত ও দ্রুত হিসেব করা যায় এমন যন্ত্রের। এরই ধারাবাহিকতায় নেপিয়ার অস্থি (১৬৫০-১৬১৭), স্লাইডরুল(১৬২২) ও পরবর্তীতে ১৬৭১ সালে জার্মান গনিতবিদ লাইবনিৎস চাকা ও দন্ড ব্যবহার করে হিসেব করার জন্য প্যাস্কেলের যন্ত্র আবিষ্কার করেন।
এরপর ফ্রান্সের টমাস ডি কলমারের আবিষ্কার করা হস্তচালিত ক্যালকুলেটর হিসেব নিকাশ করার কাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর এভাবেই প্রতিনিয়ত গননা যন্ত্রের আধুনিকায়নের ফলে ১৯৩৭ সালের দিকে তৈরি করা হয় পৃথিবীর প্রথম অটোমেটিক ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার (মার্ক-১)।
শুরুতেই সবচেয়ে জঠিল ও কঠিন সব হিসেব করার জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করা হতো, এর জন্য এর নাম করণও হয় গননা যন্ত্র হিসেবে। কিন্তু কালের বির্বতনে ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে কম্পিউটার এখন অনেক ধরনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে।
প্রথম দিকে কম্পিউটারগুলো ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল পদ্ধতিতে পরিচালনা হত। তাতে করে পরিচালনায় অনেক সময় ব্যয় হত ও আয়তনে বিশাল আকৃতিতে হওয়ার ফলে নিয়ন্ত্রণেও অনেক সমস্যা হত। এরও আগে ১৮৩৪ থেকে ১৮৪৩ সালের মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামের ধারণা দেন অগাস্টা এডা বায়রন।
এরপর থেকেই প্রোগ্রামিং ভাষার বিভিন্ন অংশ যেমন: বুলিয়ান এলজেবরা, লগারিদম, অ্যালগরিদম ইত্যাদি আবিষ্কার হতে থাকে। তারপর থেকে গবেষকরা বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং ভাষা আবিষ্কার করে এর ফলে ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল যন্ত্রাংশের পরিবর্তে সফটওয়্যার ভিত্তিক কম্পিউটার ব্যবস্থার চালু হয়। আ
র এত সব আবিষ্কারের ফলে তৈরি হতে থাকে উচ্চতর কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা বা Machine language।
কম্পিউটার কিভাবে বুজতে পারে মেশিন ভাষা (Machine language):
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে একটা মেশিন কিভাবে মানুষের কমান্ড বুজতে পারে। বিষয়টি আমাদের কাছে আশ্চর্য মনে হলেও কিন্তু কম্পিউটার একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে কমান্ড বুজতে পারে।
কম্পিউটার শুধু মেশিন ভাষা ০ ও ১ এবং হেক্স পদ্ধতি অর্থাৎ অন ও অফ বুজতে পারে, আর এই ০ ও ১ অর্থাৎ বাইনারি সংখ্যা অথবা হেক্স পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু বুজতে পারে না।
তাই আপনি কম্পিউটারকে যে কমান্ডেই করুন না কেন কম্পিউটারকে ০ ও ১ অথবা হেক্স পদ্ধতিতে তা বুজাতে হবে, আর এই বুঝানোর কাজটিই করে প্রোগ্রামিং ভাষা।
আমরা কম্পাইলার ও ইন্টারপ্রিটার ব্যবহার করে বিভিন্ন শব্দ, বর্ণ, সংকেত, চিহৃ এর বিন্যাস করে এমন প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহার করে আমাদের প্রয়োজনীয় কমান্ড লিখি।
কম্পাইলার ও ইন্টারপ্রিটার তা কম্পিউটারকে বুঝাতে পারে এমন পদ্ধতিতে রুপান্তরিত করে। এভাবেই কম্পিউটার মানুষের দেওয়া বিভিন্ন কমান্ড বুজতে পারে ও কাজ করতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং ভাষা (Different types of programming languages:):
১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কয়েকশত প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ তৈরি হয়, আর সে সকল ভাষা তৈরি ও বিবর্তনের এক একটি অংশকে ভাষার জেনারেশন বা প্রজন্ম বলা হয়। এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া সকল ভাষাকে পাঁচটি প্রজন্মে বা জেনারেশনে ভাগ করা হয়েছে।
১. প্রথম প্রজন্মের ভাষা: ১৯৪৫ সালে আবিষ্কার হওয়া প্রথম মেশিন ভাষাকে প্রথম প্রজন্মের ভাষা বলা হয়। প্রথম প্রজন্মের ভাষায় কম্পিউটার শুধু ০ ও ১ বাইনারি অথবা হেক্স পদ্ধতিতে কাজ করতে পারতো বা বুজতে পারতো। এর ফলে প্রথম অটোমেটিক ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার (মার্ক-১) তৈরি করা সম্ভব হয়।
২. দ্বিতীয় প্রজন্মের ভাষা: ১৯৫০ সালের দিকে তৈরি হওয়া অ্যাসেম্বল ভাষাকে বলা হয় দ্বিতীয় প্রজন্ম বা জেনারেশনের ভাষা। এ ভাষা বিভিন্ন ধরনের সাংকেতিক চিহৃ বা সংকেত সংযোগে গঠিত। অ্যাসেম্বল ভাষার মাধমে বিভিন্ন ধরনের সংকেত ব্যবহার করে কম্পিউটারকে নির্দেশনা দেওয়া হতো।
৩. তৃতীয় প্রজন্মের ভাষা: উচ্চতর বা তৃতীয় প্রজন্মের ভাষা ১৯৬০ সালের দিকে তৈরি হওয়া শুরু হয়। যা মানুষ সহজেই বুঝতে পারে ও স্মরণ রাখতে পারে এর ফলে মানুষ উন্নত প্রযুক্তিগত বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরি করতে পারছে।
তৃতীয় প্রজন্মের ভাষাগুলোর মধ্যে অন্নতম হলো:- C++, C#, BASIC, PASCAL, FORTRAN ইত্যাদি। যেগুলো নতুন নতুন সফটওয়্যার তৈরিতে আমুল পরির্বতন করেছে।
৪. চতুর্থ প্রজন্মের ভাষা: ১৯৭০ সালের দিকে অতি উচ্চতর ভাষা তৈরি হয়। এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করে সহজেই অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়। ডেটাবেজ সংরক্ষণ ও ম্যানেজমেন্টের কাজে 4GL হিসেবে এই প্রজন্মের ভাষা ব্যবহার করা হয়।
৫. পঞ্চম প্রজন্মের ভাষা: ১৯৮০ সালে স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল ভাষা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় যাতে সহজেই মানুষের ভাষা ব্যবহার করে কম্পিউটারকে সহজে বুঝানো যায়।
এধরনের ভাষাকে মেশিনের ভাষায় রুপান্তরের জন্য অনুবাদক হিসেবে বুদ্ধিমান বা ইনটেলিজেন্ট কম্পাইলার ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটার যাতে মানুষের ভাষা বুঝতে পারে সেজন্য এখনও আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
শেষ কথা:
আমরা উপরের আলোচনা থেকে ইতোমধ্যে জেনেছি যে Machine language কি, কিভাবে কাজ করে ও কিভাবে Machine language এর উৎপত্তি হলো। আর আমরা জানি যে যেভাবে তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি ও বিকাশ ঘটছে অদূর ভবিষতে হয়তো মানুষের বুদ্ধি চিন্তার অধিকার হবে কম্পিউটার প্রযুক্তি। এখন যেমন মানুষের ও ইনডাস্ট্রিয়াল অনেক কাজ কর্ম ক্রেত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা রোবটিংস করে ফেলছে, তেমনি এক সময় মানুষের মত ভাবনা চিন্তার অধিকারী করে তৈরি করা হবে কম্পিউটার প্রোগ্রাম। তাই বলা যায় কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়ন ও কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে জড়িত সকল বিষয় উন্নতির ফলে আমাদের পৃথিবী আরও উন্নত হবে, মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে।
0 টি মন্তব্য